ড. ন জ রু ল ই স লা ম
মানুষের চিন্তা-চেতনার জগতে যেসব মনীষী ব্যাপক আলোড়ন তুলেছেন- সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি আচরণকে অবলোকন, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যায় ভিন্ন মাত্রা আনয়ন করেছেন, তাদের একজন হচ্ছেন সিগমন্ড ফ্রয়েড। ফ্রয়েডকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তার সম্পর্কে শুধু এটুকুই বলা যায়, পৃথিবীকে পরিবর্তনকারী দশজন মানুষের তালিকা করলে সেই তালিকার প্রথম দিকে স্থান পান তিনি।
ফ্রয়েড মানব আচরণ ও মানব আচরণের অন্তর্হিত কারণ সম্পর্কে যেসব তত্ত্বের অবতারণা ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা ফ্রয়েড-পূর্ব সময়ে কেউ চিন্তাতেই আনেননি। ফ্রয়েডকে নিয়ে পরিপূর্ণ আলোচনা ও পর্যালোচনা করার ক্ষমতা ও দুঃসাহস আমার নেই এবং তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা মানব সভ্যতা যতদিন টিকে থাকবে ততদিন চলতেই থাকবে।
ফ্রয়েড বলেছেন, মানুষের জীবন ও কাজের মূল চালিকা হচ্ছে প্রেষণা (ফত্রাব) বা তাগিদ। তিনি এই প্রেষণাকে প্রবণতা (রহংঃরহপঃ) বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি দুই ধরনের প্রবণতার কথা বলেছেন, একটি হচ্ছে জীবন প্রবণতা (ষরভব রহংঃরহপঃ) এবং অপরটি হচ্ছে মৃত্যু প্রবণতা (ফবধঃয রহংঃরহপঃ)। ফ্রয়েডের মতে এই দুই প্রবণতা মানুষের আচরণকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
প্রথমে এই দুই প্রবণতা সম্পর্কে সামান্য আলোচনা প্রয়োজন। তা না হলে কারও কারও কাছে এই প্রবন্ধের মূল সুরটি বুঝতে অসুবিধা হবে।
ফ্রয়েড মনে করেন মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয় নানাবিধ কাজের মাধ্যমে এবং জীবন প্রবণতা মানুষকে এসব কাজে নিয়োজিত রাখে। জীবন প্রবণতার কাজে শক্তি জোগায় লিবিডো (ষরনরফড়)। ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা, ব্যথা-বেদনা অবসানের লক্ষ্যে কাজ করা, আনন্দ পাওয়া ইত্যাদি হচ্ছে জীবন প্রবণতার প্রকাশ। এর পাশাপাশি রয়েছে মরণ প্রবণতা (ফবধঃয রহংঃরহপঃ) বা মরণ নেশা।
১৯২০ সালে ‘ইবুড়হফ ঃযব ঢ়ষবধংঁত্ব ঢ়ত্রহপরঢ়ষব’ গ্রন্থে ফ্রয়েড বলেন, জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে মৃত্যু- অর্থাত্ মানুষ জন্মগ্রহণ করে মৃত্যুবরণ করার জন্য। তিনি আরও বলেন, মানুষের মধ্যে মৃত্যুবরণ করার এক অবচেতন আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। মানুষের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ, যুদ্ধ এবং জীবনমান বিনাশী কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে ফ্রয়েড এই ধারণায় উপনীত হন যে, মানুষের মাঝেই নিজেকে ধ্বংস করার এক প্রবণতা রয়েছে এবং এই প্রবণতার চালিকাশক্তি হচ্ছে থ্যানোটাস (ঞযধহড়ঃধং), যা লিবিডোর বিপরীত। লিবিডো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, অন্যদিকে থ্যানোটাস মানুষকে মৃত্যু তথা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
মহাভারতের দুর্যোধন থেকে শুরু করে ইতিহাসের পাতায় পাতায় শত শত রাষ্ট্রনায়কের উদাহরণ পাওয়া যাবে যারা ধ্বংস হয়েছেন নিজেদের কারণে, নিজেদের কর্মে এবং ফ্রয়েডের ভাষায় বলতে হয়, এদের সবাইকে পেয়ে বসেছিল মরণনেশায়, এরা চালিত হয়েছিল থ্যানোটাস দ্বারা।
এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আসীন হয়েছিলেন তাদের দিকে। ফ্রয়েডের জীবন প্রবণতা ও মরণ নেশা তত্ত্বের আলোকে বোধহয় বলা যায়, বাংলাদেশে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হন তাদের মৃত্যু প্রবণতা বা মরণ নেশায় পেয়ে বসে।
মানব আচরণ ব্যাখ্যায় ফ্রয়েডের তত্ত্বের আলোকে বোধ হয় বাংলাদেশের যেসব রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছিল এবং ভবিষ্যতে আসীন হতে পারে সেসব রাজনৈতিক দলের আচরণ ব্যাখ্যা করা যায়। আমরা বোধহয় এভাবে একটি ব্যাখ্যার সূত্রপাত করতে পারি।
রাজনৈতিক দলের লিবিডো হচ্ছে জনগণ। যে দল যত বেশি জনসমর্থন পায় তার লিবিডোর শক্তি তত বেড়ে যায়। এর বিপরীত দিকে যে দল যত বেশি জনসমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যায় তার মধ্যে বিপরীত শক্তি অর্থাত্ থ্যানোটাস দ্রুত শক্তি অর্জন করে এবং রাজনৈতিক দলকে মরণ নেশায় ঠেলে দেয় এবং মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন বিগত কয়েকটি সরকারের এবং ক্ষমতার বাইরে থাকা (বিরোধী দলে থাকা) ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তাদের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করলে হয়তো ফ্রয়েডের তত্ত্বের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে।
বর্তমান প্রবন্ধের মূল প্রপঞ্চ হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গেলেই তাদের মৃত্যু প্রবণতা পেয়ে বসে এবং যে দল যত বেশি জনসমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয় তাদের মৃত্যু প্রবণতাও তত বেশি শক্তিশালী হয়। ১৯৯১ সালের রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপির সঙ্গে ২০০১ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপি এবং ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২০০৯ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে পাঠক হয়তো অনুধাবন করতে পারবেন এই দল দুটি ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর তাদের মাঝে থ্যানোটাস বা মরণ নেশা কত শক্তিশালী হয়েছে।
১৯৯১ সালে বিএনপি এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠ সরকার। অর্থাত্ সরকার গঠন করতে তাদের অন্য দলের সাহায্য নিতে হয়েছিল। এই দুই পর্বের সরকার তত বেশি মরণ নেশায় আক্রান্ত হয়নি যেমনটি হয়েছিল ২০০১ সালের বিএনপি ও বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার।
বেশি অতীতে নাগিয়ে আমরা শুধু ২০০১ সালে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্য নিয়ে গঠিত বিএনপি সরকার ও বর্তমানে প্রায় ৯০ শতাংশ সংসদ সদস্য নিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার যে কীভাবে মৃত্যু প্রবণতায় আক্রান্ত, তার মাঝেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
২০০১ সালে বিএনপি যেদিন মন্ত্রিসভা গঠন করে সেদিন থেকেই তাদের ধ্বংস বা মৃত্যু শুরু হয়। মন্ত্রিসভায় এমন কিছু লোককে নিয়োগ দেওয়া হয় তারা যে বিএনপিকে ধ্বংস করে দেবে তা বোধহয় বিএনপি নেতৃত্ব বুঝতে পারেনি। তবে কি অনুমান করা যায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি থ্যানোটাস বা মরণ নেশায় আক্রান্ত হয়েছিল? ২০০১ সালের নির্বাচনে দিনের পর দিন রাতের পর রাত বেগম জিয়া যেভাবে দেশব্যাপী ঘুরে বেড়িয়েছেন, মানুষকে তার পক্ষে এনেছিলেন, দলকে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী করেছিলেন- কিন্তু তিনি কি কারণে মন্ত্রিসভার মাধ্যমেই মরণের দিকে যাত্রা শুরু করলেন তা বোধ হয় এখন তিনি অনুধাবন করতে পারছেন। যদি না পারেন তাহলে এটা হবে বিশাল এক ট্র্যাজেডি।
আমি বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে কিছুটা খোঁজখবর রাখি। বিএনপির মন্ত্রিসভার অর্ধেকের বেশি মন্ত্রীর নামই জানতাম না এবং তাদের অনেকের অতীত ছিল অন্ধকার এবং যোগ্যতার বিচারে বিএনপির অনেক সংসদ সদস্যের তুলনায় অযোগ্য। কিন্তু কী কারণে, কোন বিবেচনায় তাদের মন্ত্রী করা হয়েছিল তা মরণ নেশায় আক্রান্ত তত্ত্ব ছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা নেই বলেই আমার মনে হয়। ২০০১-২০০৬ সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন বিএনপির কতিপয় মন্ত্রীর কার্যকলাপ ও বক্তব্য সমাজে ব্যাপক সমালোচিত হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যে মন্ত্রীর কোনো কথার কারণে সমাজে সমালোচনার ঝড় ওঠে তখনই তাকে বরখাস্ত করা সমীচীন। হাওয়া ভবন নিয়ে প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায়, সভা-সমাবেশে, হোটেল-রেস্তোরাঁয়, চায়ের দোকানে, সামাজিক আড্ডায় অনেক সমালোচনা চলত। আলোচনা-সমালোচনা কতটা সঠিক বা বেঠিক ছিল তা জানা নেই। কিন্তু রাজনীতিতে জনপ্রত্যক্ষণ বা ঢ়ঁনষরপ ঢ়বত্পবঢ়ঃরড়হ বলে একটা কথা আছে এবং ঢ়ঁনষরপ ঢ়বত্পবঢ়ঃরড়হ-কে তখন মোটেও পাত্তা দেওয়া হয়নি। যার জের এখনও বিএনপিকে টানতে হচ্ছে।
এবার আসা যাক বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের কথায়। ১৯৯৬-২০০১ সময়ের কথা বাদ দিই। তবে ক্ষমতায় আসার পরই যে আওয়ামী লীগকে মরণ নেশায় পেয়ে বসেছিল তার প্রমাণ গডফাদারদের নামগুলো স্মরণে আনলেই বোঝা যাবে।
গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভাবিত বিজয় ছিল এক চমক। শেখ হাসিনা আরও এক চমক দেখালেন মন্ত্রিসভা গঠন করে। তার চমকে আমরা অনেকেই একদিকে যেমন চমত্কৃত হয়েছিলাম ঠিক তেমনি চমকেও উঠেছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখন বোধহয় অনুধাবন করতে পারবেন চমকে ওঠার কারণ কী ছিল। আওয়ামী লীগ বলতে যা বোঝায় বর্তমান সরকারের দিকে তাকালে কি এটাকে আওয়ামী লীগের সরকার বলা যায়? এরা কী করছেন, কী বলছেন রাস্তাঘাটে কান পাতলেই তার প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। গুপ্তচরেরা কত আজব খবরই না প্রতিদিন সরকারি উচ্চপর্যায়ে দিচ্ছেন, কিন্তু মানুষ কী বলে তা কি দিচ্ছে না? সরকারি, আধা সরকারি চাকরি যে জেলায় জেলায় মন্ত্রী-এমপির এপিএস বা পিএ নামক লোকেরা নিলামে বিক্রি করে তা কি গুপ্তচরেরা সরকারের উচ্চমহলে পৌঁছায় না? বিরোধী দলকে দমন করে লাভ নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার পিতাকে কি আইয়ুব-ইয়াহিয়া দমন করতে পেরেছিল? ইতিহাসের পাতায় আজ তারা কোথায় আর আপনার পিতা কোথায়? অথচ আপনি কেন আইয়ুব-ইয়াহিয়ার পথে হাঁটছেন?
অর্থমন্ত্রী কথা বললে শেয়ারবাজারে ধস নামে, বাণিজ্যমন্ত্রী কথা বললে দ্রব্যমূল্যে আগুন লাগে। সরকার গঠনের পর আপনার বক্তব্যে শব্দচয়নে পরিমিতবোধ প্রশংসিত হয়েছিল। এখন তা কি আছে? ভারত উপমহাদেশে তিন বাঙালি নোবেল বিজয়ী। এদের একজন একান্তই আমাদের। অধ্যাপক ইউনূস যখন নোবেল পেলেন তখন সারা দেশে আনন্দের জোয়ার কি দেখেননি? আমরা পাশের দেশের বাঙালি নোবেল বিজয়ীকে মাল্যভূষিত করি, তাকে বসাই হূদয় মন্দিরে-আমাদের একান্ত আপন নোবেল বিজয়ীকে আপনি ও আপনার সরকার যেভাবে অপমানিত করছেন তা কি আপনার বা আপনার দলের জনপ্রিয়তা বাড়াচ্ছে? আমাদের কষ্ট হয় যখন দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার দলের অনুগ্রহপ্রাপ্তরা জানা-অজানা লোককে সম্মানসূচক ডক্টরেট দেন কিন্তু ড. ইউনূসকে ডিগ্রি দিতে বাধা দেন। এটা কি ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসে? একজন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে দেশের উন্নয়নে আপনি অধ্যাপক ইউনূস বা ফজলে হাসান আবেদের মতো লোকদের কাজে লাগাতে পারতেন, কিন্তু তা না করে তাদের কীভাবে, কতভাবে অপমানিত করা যায় তা-ই করে চলছে আপনার সরকারের কতিপয় মন্ত্রী-নেতা এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এটা শুরু করেছিলেন আপনি। আপনার পিতা বিশাল হূদয়ের মানুষ ছিলেন এবং আমার ধারণা তিনি বেঁচে থাকতে বাংলাদেশের কেউ যদি নোবেল বিজয়ী হতেন, তাহলে তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, অনেক কিছুই আপনাকে মানায় না। এটা আপনাকে বুঝতে হবে। আপনার মন্ত্রীরা, এমপিরা দুর্নীতি করবে, শেয়ারবাজারে লুটপাট করবে, সরকারি-আধাসরকারি চাকরি নিলামে বিক্রি করবে, দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের অপমান করবে, বিরোধীদের ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করবে, এটা আপনাকে মানায় না। আপনি যদি এগুলো দমন না করেন, এদের ছুড়ে ফেলে না দেন তাহলে বুঝব ফ্রয়েড বেঁচে থাকলে বলতেন আপনাকে এবং আপনার দলকে পেয়ে বসেছে মরণ নেশায় এবং মরণ নেশায় পেয়ে বসলে তাকে আর বাঁচানো যায় না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আর মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী আপনাদের মরণ নেশায় আক্রান্ত হওয়া যায় না। যদি তাই হয়, সাধারণ মানুষ কোন নেশায় আক্রান্ত হবে?
ফ্রয়েড মানব আচরণ ও মানব আচরণের অন্তর্হিত কারণ সম্পর্কে যেসব তত্ত্বের অবতারণা ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা ফ্রয়েড-পূর্ব সময়ে কেউ চিন্তাতেই আনেননি। ফ্রয়েডকে নিয়ে পরিপূর্ণ আলোচনা ও পর্যালোচনা করার ক্ষমতা ও দুঃসাহস আমার নেই এবং তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা মানব সভ্যতা যতদিন টিকে থাকবে ততদিন চলতেই থাকবে।
ফ্রয়েড বলেছেন, মানুষের জীবন ও কাজের মূল চালিকা হচ্ছে প্রেষণা (ফত্রাব) বা তাগিদ। তিনি এই প্রেষণাকে প্রবণতা (রহংঃরহপঃ) বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি দুই ধরনের প্রবণতার কথা বলেছেন, একটি হচ্ছে জীবন প্রবণতা (ষরভব রহংঃরহপঃ) এবং অপরটি হচ্ছে মৃত্যু প্রবণতা (ফবধঃয রহংঃরহপঃ)। ফ্রয়েডের মতে এই দুই প্রবণতা মানুষের আচরণকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
প্রথমে এই দুই প্রবণতা সম্পর্কে সামান্য আলোচনা প্রয়োজন। তা না হলে কারও কারও কাছে এই প্রবন্ধের মূল সুরটি বুঝতে অসুবিধা হবে।
ফ্রয়েড মনে করেন মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয় নানাবিধ কাজের মাধ্যমে এবং জীবন প্রবণতা মানুষকে এসব কাজে নিয়োজিত রাখে। জীবন প্রবণতার কাজে শক্তি জোগায় লিবিডো (ষরনরফড়)। ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা, ব্যথা-বেদনা অবসানের লক্ষ্যে কাজ করা, আনন্দ পাওয়া ইত্যাদি হচ্ছে জীবন প্রবণতার প্রকাশ। এর পাশাপাশি রয়েছে মরণ প্রবণতা (ফবধঃয রহংঃরহপঃ) বা মরণ নেশা।
১৯২০ সালে ‘ইবুড়হফ ঃযব ঢ়ষবধংঁত্ব ঢ়ত্রহপরঢ়ষব’ গ্রন্থে ফ্রয়েড বলেন, জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে মৃত্যু- অর্থাত্ মানুষ জন্মগ্রহণ করে মৃত্যুবরণ করার জন্য। তিনি আরও বলেন, মানুষের মধ্যে মৃত্যুবরণ করার এক অবচেতন আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। মানুষের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ, যুদ্ধ এবং জীবনমান বিনাশী কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে ফ্রয়েড এই ধারণায় উপনীত হন যে, মানুষের মাঝেই নিজেকে ধ্বংস করার এক প্রবণতা রয়েছে এবং এই প্রবণতার চালিকাশক্তি হচ্ছে থ্যানোটাস (ঞযধহড়ঃধং), যা লিবিডোর বিপরীত। লিবিডো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, অন্যদিকে থ্যানোটাস মানুষকে মৃত্যু তথা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
মহাভারতের দুর্যোধন থেকে শুরু করে ইতিহাসের পাতায় পাতায় শত শত রাষ্ট্রনায়কের উদাহরণ পাওয়া যাবে যারা ধ্বংস হয়েছেন নিজেদের কারণে, নিজেদের কর্মে এবং ফ্রয়েডের ভাষায় বলতে হয়, এদের সবাইকে পেয়ে বসেছিল মরণনেশায়, এরা চালিত হয়েছিল থ্যানোটাস দ্বারা।
এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আসীন হয়েছিলেন তাদের দিকে। ফ্রয়েডের জীবন প্রবণতা ও মরণ নেশা তত্ত্বের আলোকে বোধহয় বলা যায়, বাংলাদেশে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হন তাদের মৃত্যু প্রবণতা বা মরণ নেশায় পেয়ে বসে।
মানব আচরণ ব্যাখ্যায় ফ্রয়েডের তত্ত্বের আলোকে বোধ হয় বাংলাদেশের যেসব রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছিল এবং ভবিষ্যতে আসীন হতে পারে সেসব রাজনৈতিক দলের আচরণ ব্যাখ্যা করা যায়। আমরা বোধহয় এভাবে একটি ব্যাখ্যার সূত্রপাত করতে পারি।
রাজনৈতিক দলের লিবিডো হচ্ছে জনগণ। যে দল যত বেশি জনসমর্থন পায় তার লিবিডোর শক্তি তত বেড়ে যায়। এর বিপরীত দিকে যে দল যত বেশি জনসমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যায় তার মধ্যে বিপরীত শক্তি অর্থাত্ থ্যানোটাস দ্রুত শক্তি অর্জন করে এবং রাজনৈতিক দলকে মরণ নেশায় ঠেলে দেয় এবং মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন বিগত কয়েকটি সরকারের এবং ক্ষমতার বাইরে থাকা (বিরোধী দলে থাকা) ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তাদের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করলে হয়তো ফ্রয়েডের তত্ত্বের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে।
বর্তমান প্রবন্ধের মূল প্রপঞ্চ হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গেলেই তাদের মৃত্যু প্রবণতা পেয়ে বসে এবং যে দল যত বেশি জনসমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয় তাদের মৃত্যু প্রবণতাও তত বেশি শক্তিশালী হয়। ১৯৯১ সালের রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপির সঙ্গে ২০০১ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপি এবং ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২০০৯ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে পাঠক হয়তো অনুধাবন করতে পারবেন এই দল দুটি ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর তাদের মাঝে থ্যানোটাস বা মরণ নেশা কত শক্তিশালী হয়েছে।
১৯৯১ সালে বিএনপি এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠ সরকার। অর্থাত্ সরকার গঠন করতে তাদের অন্য দলের সাহায্য নিতে হয়েছিল। এই দুই পর্বের সরকার তত বেশি মরণ নেশায় আক্রান্ত হয়নি যেমনটি হয়েছিল ২০০১ সালের বিএনপি ও বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার।
বেশি অতীতে নাগিয়ে আমরা শুধু ২০০১ সালে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্য নিয়ে গঠিত বিএনপি সরকার ও বর্তমানে প্রায় ৯০ শতাংশ সংসদ সদস্য নিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার যে কীভাবে মৃত্যু প্রবণতায় আক্রান্ত, তার মাঝেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
২০০১ সালে বিএনপি যেদিন মন্ত্রিসভা গঠন করে সেদিন থেকেই তাদের ধ্বংস বা মৃত্যু শুরু হয়। মন্ত্রিসভায় এমন কিছু লোককে নিয়োগ দেওয়া হয় তারা যে বিএনপিকে ধ্বংস করে দেবে তা বোধহয় বিএনপি নেতৃত্ব বুঝতে পারেনি। তবে কি অনুমান করা যায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি থ্যানোটাস বা মরণ নেশায় আক্রান্ত হয়েছিল? ২০০১ সালের নির্বাচনে দিনের পর দিন রাতের পর রাত বেগম জিয়া যেভাবে দেশব্যাপী ঘুরে বেড়িয়েছেন, মানুষকে তার পক্ষে এনেছিলেন, দলকে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী করেছিলেন- কিন্তু তিনি কি কারণে মন্ত্রিসভার মাধ্যমেই মরণের দিকে যাত্রা শুরু করলেন তা বোধ হয় এখন তিনি অনুধাবন করতে পারছেন। যদি না পারেন তাহলে এটা হবে বিশাল এক ট্র্যাজেডি।
আমি বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে কিছুটা খোঁজখবর রাখি। বিএনপির মন্ত্রিসভার অর্ধেকের বেশি মন্ত্রীর নামই জানতাম না এবং তাদের অনেকের অতীত ছিল অন্ধকার এবং যোগ্যতার বিচারে বিএনপির অনেক সংসদ সদস্যের তুলনায় অযোগ্য। কিন্তু কী কারণে, কোন বিবেচনায় তাদের মন্ত্রী করা হয়েছিল তা মরণ নেশায় আক্রান্ত তত্ত্ব ছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা নেই বলেই আমার মনে হয়। ২০০১-২০০৬ সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন বিএনপির কতিপয় মন্ত্রীর কার্যকলাপ ও বক্তব্য সমাজে ব্যাপক সমালোচিত হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যে মন্ত্রীর কোনো কথার কারণে সমাজে সমালোচনার ঝড় ওঠে তখনই তাকে বরখাস্ত করা সমীচীন। হাওয়া ভবন নিয়ে প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায়, সভা-সমাবেশে, হোটেল-রেস্তোরাঁয়, চায়ের দোকানে, সামাজিক আড্ডায় অনেক সমালোচনা চলত। আলোচনা-সমালোচনা কতটা সঠিক বা বেঠিক ছিল তা জানা নেই। কিন্তু রাজনীতিতে জনপ্রত্যক্ষণ বা ঢ়ঁনষরপ ঢ়বত্পবঢ়ঃরড়হ বলে একটা কথা আছে এবং ঢ়ঁনষরপ ঢ়বত্পবঢ়ঃরড়হ-কে তখন মোটেও পাত্তা দেওয়া হয়নি। যার জের এখনও বিএনপিকে টানতে হচ্ছে।
এবার আসা যাক বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের কথায়। ১৯৯৬-২০০১ সময়ের কথা বাদ দিই। তবে ক্ষমতায় আসার পরই যে আওয়ামী লীগকে মরণ নেশায় পেয়ে বসেছিল তার প্রমাণ গডফাদারদের নামগুলো স্মরণে আনলেই বোঝা যাবে।
গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভাবিত বিজয় ছিল এক চমক। শেখ হাসিনা আরও এক চমক দেখালেন মন্ত্রিসভা গঠন করে। তার চমকে আমরা অনেকেই একদিকে যেমন চমত্কৃত হয়েছিলাম ঠিক তেমনি চমকেও উঠেছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখন বোধহয় অনুধাবন করতে পারবেন চমকে ওঠার কারণ কী ছিল। আওয়ামী লীগ বলতে যা বোঝায় বর্তমান সরকারের দিকে তাকালে কি এটাকে আওয়ামী লীগের সরকার বলা যায়? এরা কী করছেন, কী বলছেন রাস্তাঘাটে কান পাতলেই তার প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। গুপ্তচরেরা কত আজব খবরই না প্রতিদিন সরকারি উচ্চপর্যায়ে দিচ্ছেন, কিন্তু মানুষ কী বলে তা কি দিচ্ছে না? সরকারি, আধা সরকারি চাকরি যে জেলায় জেলায় মন্ত্রী-এমপির এপিএস বা পিএ নামক লোকেরা নিলামে বিক্রি করে তা কি গুপ্তচরেরা সরকারের উচ্চমহলে পৌঁছায় না? বিরোধী দলকে দমন করে লাভ নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার পিতাকে কি আইয়ুব-ইয়াহিয়া দমন করতে পেরেছিল? ইতিহাসের পাতায় আজ তারা কোথায় আর আপনার পিতা কোথায়? অথচ আপনি কেন আইয়ুব-ইয়াহিয়ার পথে হাঁটছেন?
অর্থমন্ত্রী কথা বললে শেয়ারবাজারে ধস নামে, বাণিজ্যমন্ত্রী কথা বললে দ্রব্যমূল্যে আগুন লাগে। সরকার গঠনের পর আপনার বক্তব্যে শব্দচয়নে পরিমিতবোধ প্রশংসিত হয়েছিল। এখন তা কি আছে? ভারত উপমহাদেশে তিন বাঙালি নোবেল বিজয়ী। এদের একজন একান্তই আমাদের। অধ্যাপক ইউনূস যখন নোবেল পেলেন তখন সারা দেশে আনন্দের জোয়ার কি দেখেননি? আমরা পাশের দেশের বাঙালি নোবেল বিজয়ীকে মাল্যভূষিত করি, তাকে বসাই হূদয় মন্দিরে-আমাদের একান্ত আপন নোবেল বিজয়ীকে আপনি ও আপনার সরকার যেভাবে অপমানিত করছেন তা কি আপনার বা আপনার দলের জনপ্রিয়তা বাড়াচ্ছে? আমাদের কষ্ট হয় যখন দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার দলের অনুগ্রহপ্রাপ্তরা জানা-অজানা লোককে সম্মানসূচক ডক্টরেট দেন কিন্তু ড. ইউনূসকে ডিগ্রি দিতে বাধা দেন। এটা কি ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসে? একজন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে দেশের উন্নয়নে আপনি অধ্যাপক ইউনূস বা ফজলে হাসান আবেদের মতো লোকদের কাজে লাগাতে পারতেন, কিন্তু তা না করে তাদের কীভাবে, কতভাবে অপমানিত করা যায় তা-ই করে চলছে আপনার সরকারের কতিপয় মন্ত্রী-নেতা এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এটা শুরু করেছিলেন আপনি। আপনার পিতা বিশাল হূদয়ের মানুষ ছিলেন এবং আমার ধারণা তিনি বেঁচে থাকতে বাংলাদেশের কেউ যদি নোবেল বিজয়ী হতেন, তাহলে তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, অনেক কিছুই আপনাকে মানায় না। এটা আপনাকে বুঝতে হবে। আপনার মন্ত্রীরা, এমপিরা দুর্নীতি করবে, শেয়ারবাজারে লুটপাট করবে, সরকারি-আধাসরকারি চাকরি নিলামে বিক্রি করবে, দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের অপমান করবে, বিরোধীদের ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করবে, এটা আপনাকে মানায় না। আপনি যদি এগুলো দমন না করেন, এদের ছুড়ে ফেলে না দেন তাহলে বুঝব ফ্রয়েড বেঁচে থাকলে বলতেন আপনাকে এবং আপনার দলকে পেয়ে বসেছে মরণ নেশায় এবং মরণ নেশায় পেয়ে বসলে তাকে আর বাঁচানো যায় না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আর মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী আপনাদের মরণ নেশায় আক্রান্ত হওয়া যায় না। যদি তাই হয়, সাধারণ মানুষ কোন নেশায় আক্রান্ত হবে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন