শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

অর্থমন্ত্রীর জন্য শুভকামনা

জাফর আহমেদ চৌধুরী | তারিখ: ২০-০৫-২০১২


চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে স্থিরমূল্যে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার কত হবে, এ নিয়ে যথেষ্ট বাগিবতণ্ডা চলছে। এডিবি বলছে, সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ২ শতাংশ। আইএমএফ বলছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলছেন, এ ধরনের হিসাবগুলো তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে করা। তিনি বলছেন, প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের কাছাকাছি হবে। কারণ, দেশের আবার নিজস্ব পদ্ধতি আছে তো! পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন, অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের প্রবৃদ্ধির সামষ্টিক একটা রূপই হলো জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার। আসল প্রবৃদ্ধির হার ২০০৬-এ ছিল ৬ দশমিক ৬৩। ২০০৭ ও ২০০৮ অর্থবছরে একটু একটু করে কমে ২০০৯-এ তা সর্বনিম্ন ৫ দশমিক ৭৪-এ পৌঁছায়। ২০১০ এবং ২০১১ অর্থবছরে এসে তার উন্নতি ঘটে। প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬ দশমিক ০৭ এবং ৬ দশমিক ৮৮। চলতি অর্থবছরে অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টরের অবদান খতিয়ে দেখলে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভবপর নয় বলে প্রতীয়মান হয়। চলতি বছরে আমন-বোরো-গমের উৎপাদন গত বছরের চেয়ে তেমন বেশি হয়নি। শিল্প খাতেও উৎপাদন বিগত বছরের তুলনায় বেশি হবে না। কারণ, গ্যাস, বিদ্যুৎ-সংকট ও শ্রমিক অসন্তোষ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আর্থিক সেক্টরে আশাপ্রদ অগ্রগতি নেই। রপ্তানি-বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধির হার গত বছরের তুলনায় কম। বিনিয়োগ/জিডিপির অনুপাত ২৫ শতাংশের ওপরে নয়। যোগাযোগ, পরিবহন, নির্মাণ ও হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতে প্রবৃদ্ধির হার কিছু বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সবকিছু মিলিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ভবিষ্যদ্বাণী প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে সত্য হতে পারে। অঙ্কের মারপ্যাঁচে বড়জোর ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে।
আগামী ২০১২-১৩ অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী হয়তো ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ঘোষণা দেবেন। তাঁর ঘোষণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অর্থনীতি যদি হাঁটা নয়, দৌড়াতে পারে, তা হলে হয়তো ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভবপর হতে পারে। প্রজেকশন করলে দেখা যায় যে বিনিয়োগ হতে হবে জিডিপির কমপক্ষে ৩২ শতাংশ। শিল্প খাতে ৮-৯ শতাংশের পরিবর্তে প্রবৃদ্ধি হতে হবে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ। নির্মাণ ও রিয়েল এস্টেট খাতের প্রবৃদ্ধি চলতি বছরের তুলনায় ৩ থেকে ৪ শতাংশ বেশি হতে হবে। অনুরূপ প্রবৃদ্ধি বাড়তে হবে যোগাযোগ, পরিবহন এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতে। মূল্যস্ফীতি দুই ডিজিটের নিচে থাকতে হবে। ৫ মে বিবিএস বলছে, মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৩। এটি অর্থহীন। মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশের মধ্যে থাকা উচিত। এটি হচ্ছে আশার বিপরীতে আশা। এমন ধরনের আশা করা যায় তখন, যখন মঞ্চে সবাই সমানতালে নাচবেন।
অর্থনীতির সব সেক্টর তখনই ভালো পারফর্ম করবে, যখন গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। মূল্যস্ফীতি যুক্তিসংগত পর্যায়ে থাকবে। দেশে সুশাসন থাকবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনপ্রশাসন সত্যিকারভাবে সেবা দেবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের বন্ধু হবে। নাগরিকেরা ‘ঘরে খুন, বাহিরে গুম’ আতঙ্কে থাকবে না। হরতাল হবে না। সরকার ব্যাংকঋণ নেবে না, উন্নয়নের নামে টাকা লুটপাট হবে না। কালোটাকা সাদা করার ব্যবস্থা থাকবে না। কিন্তু এ অনুমান বা সুবচনগুলো কতটুকু বাস্তবসম্মত?
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী স্বাভাবিকভাবে তাঁর উচ্চাভিলাষের কথা বলবেন। তাঁর আশাবাদ ব্যক্ত করবেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের সেরা ছাত্র। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের কারা নির্যাতিত। ‘প.স.’ সিভিল সার্ভেন্ট। সিভিল সার্ভিসে আসার পর তাঁর চেহারা দেখেই বিমোহিত হয়ে যেতাম। আলাপচারিতায় মনোমুগ্ধকর। জাতীয় পার্টির শাসনামলে কিছু সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন। অভিজ্ঞতা আছে অনেক। এ প্রসঙ্গে আমার চোখে দেখা দুজন অর্থমন্ত্রীর কথা এসে যায়। তাঁরা হলেন, মরহুম শাহ এ এম এস কিবরিয়া এবং মরহুম সাইফুর রহমান। প্রথমজন অর্থনীতির সেরা ছাত্র। ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া। ক্যারিয়ার কূটনীতিক। ইউএন সংস্থায় কাজ করায় অভিজ্ঞ। নির্বাচিত সাংসদ হিসেবে দেশের অর্থমন্ত্রী। সাইফুর রহমান চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। ভারতীয় উপমহাদেশে সৌভাগ্যবান অর্থমন্ত্রী। জাতিকে প্রায় ১৪টি বাজেট দিয়েছেন। ম্যাক্রো-ইকোনমিক ব্যবস্থাপনার সফলতায় চৌকস ব্যক্তিত্ব। দুজনই ভাষা আন্দোলনের কারা নির্যাতিত। তাঁদের আমলে ও চলমান আমলের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আছে। তাঁদের আমলেও হরতাল ছিল। কিন্তু, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল বেশি। ২০০০ এবং ২০০৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৯৪ এবং ৬ দশমিক ৬৩। জিডিপির ৩ শতাংশের ওপরে বাজেট ঘাটতি ছিল না। এখন যা ৫ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি। তখন সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে এত বেশি ঋণ নেয়নি। দ্রব্যমূল্য নিয়ে এত হইচই ছিল না। বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনকার তুলনায় কম ছিল। কিন্তু, তথ্যবিভ্রাট ছিল না। উল্লেখ্য, সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সচিবদের সঙ্গে এক সভায় বিদ্যুতের উল্টাপাল্টা হিসাব-নিকাশ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। অধিকন্তু, তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতটা অস্পর্শা ছিল না। বাংলা ভাই আর শায়খ রহমানরা আইনের আওতায় এসেছিল। এখন যেকোনো ঘটনায় (অতি সাম্প্রতিক ইলিয়াস আলীর গুম ও সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি) বলা হচ্ছে, ‘আমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করছে। তদন্তের পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এটি ব্রিটিশ রাজনীতিক ও প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম বার্ক ও একজন মহিলার গল্পের মতো। বার্ক প্রথম জীবনে ভালো বক্তব্য দিতে পারতেন না। ফলে আমতা আমতা করতেন। এক সভায় তিনি পরপর তিনবার বলেছিলেন, ‘আই কনসিভ’। বাকি কথা মুখে আসছিল না। এক মহিলা দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ‘বার্ক, তুমি তিনবার কনসিভ করেছ। একটি সন্তানও জন্ম দিতে পারলে না। আমি একবার কনসিভ করলেই একটি সন্তান জন্ম দিই।’ দায়িত্বশীল অনেকের বক্তৃতায় বলা হয়, ‘হবে, হবে, হবে’। কিন্তু কিছুই হয় না। এদিকে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা। ছাত্র ছাত্রকে কুপিয়ে মারে। শিক্ষকের গায়ে হাত ওঠে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আগে আমরা টেন পার্সেন্টের অনেক গল্প শুনতাম। এখন সংবাদপত্র লিখছে, ৩০ শতাংশের বেশি মাঠপর্যায়ে যায় না। ফলে আয়বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। কালোটাকা সাদা করার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। মানবসম্পদও একটি বিচার্য বিষয়। শাহ এ এম এস কিবরিয়ার সময় ড. আকবর আলি খান অর্থসচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। সাইফুর রহমান সাহেবের তৃতীয় মেয়াদে অর্থসচিব ছিলেন জাকির আহমেদ খান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ ও ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ওনারা সাহসিকতার সঙ্গে কথা বলতেন। 
যে বিষয়গুলোর অবতারণা করলাম তার সবই উন্নয়ন অর্থনীতির আওতাভুক্ত। সম্প্রতি বেশ কিছু আলোচনায় বন্ধুবর ড. দেবপ্রিয় ‘ঘনায়মান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার’ কথা বলেছেন। ভ্রাতৃপ্রতিম ড. মুস্তাফিজও একই কথা বলেছেন। কথাগুলো আদৌ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কথাগুলো সামষ্টিক ব্যবস্থাপনার অঙ্গ। এ কথাগুলো অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে কেবিনেট সভায়, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এবং বাজেট বক্তৃতায় বলতে হবে। সামষ্টিক সহযোগিতা না পেলে সাদা মনের অধিকারী অর্থমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে একবার বলতে হবে, ‘অল বোগাস, রাবিশ’। তা না বললে, ইংরেজি সাহিত্যের সেরা ছাত্র হিসেবে শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজারের ভাষায় বলতে হবে, ‘দি ফলট, ডিয়ার ব্রুটাস, ইজ নট ইন আওয়ার স্টার্স, বাট ইন আওয়ার সেলভস, দ্যাট উই আর আন্ডার লিংস’। অর্থাৎ দোষটা ভাগ্যের নয়, আমাদের নিজেদের। যা আমরা করছি। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর জন্য শুভকামনা। 
জাফর আহমেদ চৌধুরী: সাবেক পরিকল্পনাসচিব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন