মোঃ আ বু সা লে হ সে কে ন্দা র
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার করার পর সব বন্ধুর সঙ্গের আগের মতো যোগাযোগ নেই। সবাই কর্মব্য¯—। তাই কথা হয় কদাচিৎ। সহপাঠীদের অনেককে আবার একেবারে ভুলতে বসেছি। তবে ফেসবুকের কল্যাণে মাঝে মাঝে কারও কারও সুখবরগুলো পাই। বিশেষ করে আজ আমিনুল ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে তো কাল সুমীর বিয়ে হয়েছে। আবার মাঝে মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গেলে বেকার বন্ধুগুলোর দেখা মেলে। তারাও কর্মব্য¯—। যে করেই হোক একটা চাকরি চাই। এভাবে আর কত দিন! এই দলের লিডার রনির সঙ্গে মাঝে মাঝে জোর করে ঢাবির লাইব্রেরির সামনে অথবা হাকিম চত্বরে আড্ডা দেই। এ রকম আড্ডাতে ঢাকার বাইরে চাকরিরত দুই-একজন বন্ধুকে মাঝে মাঝে পেয়ে যাই। এসব আড্ডাতে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিচারণ বেশি হয়। এর সঙ্গে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তো থাকেই। সাথীর বিয়ে হয়েছে এ কথা শুনে রনির প্রশ্ন, ‘এখন নূরল হুদার কী হবে?’ সিলেটের ব্যাংকার আজহার বলে, ‘আরে নূরল হুদা নয়, ফিরোজের জন্য বড় কষ্ট হয়।’ আমি বলি, ‘বাদ দে এসব কথা। বরং চল পান্নাকে অভিনন্দন জানাই।’ মাত্র কয়েকদিন হল পান্নার বিয়ে হয়েছে আমাদের আর এক সহপাঠী লন্ডনপ্রবাসী মোকাররমের সঙ্গে। আমাদের ক্লাসে যে কয়টা জুটি ‘টপ অব দ্য ক্যাম্পাস’ ছিল তারা ছিল অন্যতম। তাদের বিয়ের গল্প লায়লী-মজনুর প্রেমের উপাখ্যানকেও হার মানাবে। সব বাধা পেরিয়ে তারা যে সফল হয়েছে, এতেই আমি খুশি। কিন্তু আমার এ প্র¯—াব বা¯—ব রূপ পায় না। কারণ আগামীকাল হরতাল। চাকরি বাঁচাতে আজহারকে সন্ধ্যার মধ্যে সিলেটের গাড়ি ধরতে হবে। আর আমারও বাসা ঢাকার অন্যপ্রাšে—। তাই অচিরেই আড্ডার পরিসমাপ্তি ঘটে। নানা স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে আমরা যে যার গš—ব্যে রওনা হই।
শাহবাগ মোড়ে এসে গাড়ির অপে¶া করছি। আমার মতো শ’দুয়েক মানুষ তৃষ্ণার্ত কাকের মতো পথের পানে চেয়ে আছে। আবার কেউ কেউ উদভ্রাšে—র মতো হেঁটে গš—ব্যের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। আমি যানবাহনের খোঁজে এদিক-ওদিক চাই। কিন্তু যতদূর চোখ যায় রিকশা, সিএনজি অথবা বাস কিছুই চোখে পড়ে না। মনে মনে প্রীত হই। আজ অš—ত যানজটে পড়তে হবে না। একটা যানবাহন পেলেও দ্র“ত বাসায় পৌঁছাতে পারব। তবে আমার সেই আশা অচিরেই দুরাশায় পরিণত হয়। দীর্ঘ এক ঘণ্টা অপে¶া করার পরও কোন যানবাহন জোগাড় করতে ব্যর্থ হই। দুই-একটি রিকশা বা সিএনজি মাঝে মাঝে দেখা দিলেও মানুষের চাপে আমি তাদের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। অগত্যা আমিও অনেকের মতো পদব্রজে রওনা হই বাসার উদ্দেশে। কোন যানজট নেই। তবে আছে মানুষ জট। যাত্রাপথে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে দীর্ঘ দুই ঘণ্টার পদব্রজে অবশেষে বাসায় পৌঁছাই। আমার এই দীর্ঘ হাঁটার কথা শুনে বউ খুশি। আমি অবাক হলাম। সে আমার এই দুর্দশা দেখে কষ্ট পাবে কী বরং আন্দন করছে। হাসতে হাসতে বলছে, ‘এভাবে তোমার প্রতিদিন ঘণ্টাচারেক হাঁটা উচিত। তাহলে শরীরে মেদ জমবে না।’ বুঝলাম, হরতাল অš—ত এজনকে খুশি করতে পেরেছে!
দুই
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ঘটনা অনেক দূর গড়িয়েছে। এ ঘটনার জন্য সরকারি দল বিরোধী দল একে অপরকে দায়ী করছে। বিএনপি ইলিয়াসকে ফেরত না দেয়া পর্যš— কঠোর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ইতিমধ্যে বিএনপি কয়েকদিন হরতাল পালনও করেছে। হরতালের আগের দিন বাস চালক আমার গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশী বদর আলী আর সাভারে গাড়ি চালক আগুনে পুড়ে নিহত হয়েছেন। বিশ্বনাথে পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত হওয়ার খবর সংবাদ মাধ্যমে জেনেছি। ভাবছি, আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে অš—ত এক জায়গায় মিল আছে। উভয়েই বলছে, তারা দেশ ও জনগণের ¯^ার্থে কাজ করছে। আর বা¯—বে উভয়ে দেশ ও জনগণের ¶তি হয় এমন কাজই প্রতিনিয়ত করে চলছে। দেখার কেউ নেই। আমার এই ভাবনার ছেদ ঘটে কাকলির ফোনে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু-সহপাঠী। ফোন রিসিভ করতেই কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, ‘সালেহ সুখীকে ওর শ্বশুরবাড়ির লোক মেরে ফেলেছে।’ কাকলির কাছ থেকেই জানলাম, কন্যা-সš—ান জম্ম দেয়ার কারণেই তাকে সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। বুঝলাম, আমরা আবার জাহেলিয়ার যুগে ফিরে যাচ্ছি। যে যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল গুম, হত্যা, যুদ্ধ। কন্যা-সš—ানকে যেখানে জীবš— কবর দেয়া হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণী পাওয়া একজন মেয়েকে কন্যা-সš—ান জম্ম দেয়ার অপরাধে মেরে ফেলা হয়। এটা জাহেলিয়াত ছাড়া আর কী! কাকলির সঙ্গে কথা শেষ হতে আরও এক বন্ধু মুরাদের ফোন, সালেহ সুখী হত্যার বিচারের দাবিতে আমরা অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন করব। আমি তার কথায় সায় দিলাম। কিন্তু মনে মনে বললাম, যে দেশে পুলিশ সাংবাদিক সাগর-র“নির হত্যাকাÊের ক‚লকিনারা করতে পারে না, যেখানে প্রভাবশালী রাজনীতিক ইলিয়াস আলী গুম হয়, রাজনীতিবিদ আহসানুলাহ মাস্টার, শাহ এ এস এম কিবরিয়া, সাংবাদিক শামসুর রহমান, হুমায়ুন কবীর বালু হত্যার বিচার হয় না, সেখানে কোথাকার কোন সুখী! তার জন্য একটা মানববন্ধন করলে সরকার আসামিদের ধরে সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলাবে মনে হয় না। কিন্তু বন্ধুদের মন কী আর এগুলো বোঝে! অগত্যা মানববন্ধন করতে রাজি হলাম। অবশেষে শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি পরিবারের ব্যানারে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন হল। বিভাগের শি¶ক ড. আখতার“জ্জামান, অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান, আতাউর রহমান বিশ্বাস ও মিয়াজী, ড. আবদুল বাছির, মফিজুর রহমান, শামসুজ্জোহাসহ প্রায় সব শি¶ক এবং অগণিত সাধারণ ছাত্রছাত্রী উপস্থিত হয়। শি¶করা বক্তৃতা করেন। অনেকে হত্যাকারীদের বিচার না করলে রাজনীতিবিদদের মতো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলে হুঙ্কার দিলেন। আমি মনে মনে হাসলাম। জানি, এগুলো বলতে হয়, তাই বলা। বা¯—বিকপ¶ে কিছুই হবে না। আমরা এর আগে এফ রহমান হলের ছাত্রলীগের দুই প¶ের সংঘর্ষে এই বিভাগের শি¶ার্থী আবুবকর নিহত হওয়ার পরও মানববন্ধন করেছিলাম। কই এখনও পর্যš— কোন হত্যাকারীর বিচার হয়নি। বরং তৎকালীন হলের সাধারণ সম্পাদক এখন বড় পদ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি।
যা হোক, মানববন্ধন শেষে বন্ধুরা অনেক দিন পরে একত্রিত হতে পেরে কিছু¶ণ খোসগল্প করলাম। দীর্ঘদিন পর বান্ধবী মিনির সঙ্গে দেখা। তার কাছে আমাদের আর এক বান্ধবী শাš—নার খোঁজ নিতে জানাল, সে আমাদের এক সহপাঠী আনিসকে গোপনে বিয়ে করেছে। শুনে খুশি হলাম। আনিস যখন আমার বন্ধু নাজুর কাছ থেকে প্রেমের প্র¯—াব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, তখন জীবন সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েছিল। আনিসকে এই জীবন থেকে ফিরিয়ে আনতে মিনিই শাš—নার সঙ্গে আনিসের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতে নানাভাবে সহায়তা করেছিল। কিন্তু উপকার করলে প্রতিদান সর্বদা ভালোভাবে পাওয়া যায় না। তা মিনি কয়দিন পরেই বুঝেছিল। কারণ আনিসের সঙ্গে প্রেম হওয়ার পর মিনি শাš—নার বন্ধুত্ব আর টেকেনি। তাই আজ মজা করেই মিনির কাছে শাš—নার খবর জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম, আজও মিনি শাš—নার খবর রাখে। একেই বলে প্রকৃত বন্ধু। উপরন্তু মিনি আ¶েপ করছিল, জানিস সালেহ শাš—নার ভাই আর ভাবী আজও আনিস শাš—নার বিয়েটা মেনে নেয়নি। আমি বললাম, পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে এ জন্যই হয়তো ভাবী-ভাইয়ের এমন অভিমান। আ¯ে— আ¯ে— সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই চিš—া করিস না। এরপর মিনি যেন আরও কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার সময় কোথায়। দুপুর গড়িয়ে পড়š— বিকাল। আগামীকাল আবারও বিএনপি হরতাল ডেকেছে। গত সপ্তাহে হরতালের পূর্ব দিনে হেঁটে বাসায় ফেরার অভিজ্ঞতার কথা মনে করে আজ আর দেরি করতে চাইনি। অগত্যা বন্ধুদের কাছে বিদায় নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা হই। আর যাত্রাপথে সবকিছু ছাপিয়ে সুখীর মুখটা বারবার ভেসে উঠছে। জানি না, এই হত্যার কোন বিচার হবে কিনা! হয়তো আবারও নতুন কোন সুখী খুন হলে সংবাদপত্রে ছবি ছাপা হবে। তার বন্ধুরা মানববন্ধন করবে। তারপর সব কিছু প্রকৃতির নিয়মে আমরা ভুলে যাব। শুধু ভুলবে না সুখীর পিতা। ২৬ বছর আগে যিনি পিতা হওয়ার আনন্দে নিজের কন্যার নাম রেখেছিলেন সুখী। আর আজ সেই কন্যাকেই কন্যা-সš—ান জম্ম দেয়ার অপরাধে মৃত্যুররণ করতে হল। কী নিষ্ঠুর এই পৃথিবী!
মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার : শি¶ক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ংধষধয.ংধশবহফবৎ@মসধরষ.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন