ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
বাং লাদেশে কোন মধ্যবর্তী নির্বাচন না হয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দশম সংসদ নির্বাচনের আর দেড় বছর বাকি। এ নির্বাচনটি নিয়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষের আলাপ-আলোচনা চায়ের কাপে তুফান তুলেছে। এ আলোচনার অন্যতম বিষয়বস্তু হলো আলোচ্য নির্বাচনটি কেমন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল রয়েছে। দশম সংসদ নির্বাচন বিষয়ক এ অগ্রিম আলোচনার ক্ষেত্রটি তৈরি করেছে মহাজোট সরকার। কারণ, সরকার যদি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল না করতো তাহলে সাবেক সংবিধানে সন্নিবেশিত ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। সে ক্ষেত্রে সবার লক্ষ্য থাকতো কে হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তারপর নির্বাচন সন্নিকটে এলে কোন দশ ব্যক্তিত্ব তত্ত্বাবধাক সরকারের উপদেষ্টা হবেন সে বিষয় নিয়েও আলাপ আলোচনা শুরু হতো। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়ে যাওয়ায় এখন নির্বাচনকালীন সময় সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কে হবেন সে বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন কোন অঙ্ক কষাকষি নেই, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ বিষয়ে নেই সামান্যতম আগ্রহ। পরিবর্তে, নাগরিক সমাজ এখন ভাবছে, নির্বাচন কি দলীয় নাকি নির্দলীয় সরকারের অধীনে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন যে বিরোধী দলগুলো মেনে নিতে চাইবে না এবং এ উদ্যোগ নিলে যে রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধি পাবে সে বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। সুশীল সমাজ এখন যে বিষয়ে জানতে আগ্রহী তা হলো, যদি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হয় তাহলে আর একবার সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হবে, নাকি অন্য কোন নাম দিয়ে নির্দলীয় সরকার সরকার গঠন করা হবে। নতুন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা কেমন হবে সে বিষয়েও তাদের যথেষ্ট কৌতূহল রয়েছে।
সরকার উচ্চ আদালতের একটি অলিখিত, অপ্রকাশিত ও বিভক্ত রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের একাংশের ওপর ভিত্তি করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে, যদিও এর মাস তিনেক আগে এ ক্ষেত্রে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে সরকার এ বিষয়ে পরিবর্তন আনে। ওই পরিবর্তন তিন মাস পরে প্রদত্ত রায়ে প্রতিফলিত হলে দেশের খ্যাতিমান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক একে ‘মারাত্মক বিষয়’ এবং সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ‘সাংবিধানিক প্রতারণা’ বলে অভিহিত করেন। যা হোক, আলোচ্য রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের বাকি অংশে জাতীয় শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা বলা ছিল। মাননীয় বিচারপতি পূর্ণাঙ্গ রায়ে হয়তো সে সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলবেন। পূর্ণাঙ্গ রায় পড়লে অনুধাবন করা যাবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে নাকচ করা সত্ত্বেও মাননীয় বিচারপতি কেন ওই সরকারের অধীনে আরও দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ দিয়েছেন এবং সে দুটি নির্বাচন করতে চাইলে কোন প্রক্রিয়ায় কিভাবে তা করা সম্ভব সে সম্পর্কেও হয়তো তিনি পূর্ণাঙ্গ রায়ে আলোকপাত করবেন। কিন্তু সরকার মাননীয় বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও প্রকাশ করা পর্যন্ত ধৈর্য না ধরেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। মাননীয় বিচারপতি তাঁর পূর্ণাঙ্গ রায়ে যদি বিরাজিত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এবং জাতীয় কল্যাণ চিন্তা করে যে দুটি নির্বাচন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার সুযোগ রেখেছিলেন সে দুটি নির্বাচন এ রকম সরকারের অধীনে করার ওপর, অথবা কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়ে সংশোধিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বা অন্য কোন রকমের নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার ওপর জোর দেন এবং সরকার যদি সে নির্দেশনা মেনে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সম্মত হয় এবং এ লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে সংশোধনী এনে সে অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয় তাহলে এ বিষয় নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক উত্তাপ হ্রাস পাবে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।
সরকার এখন যে অবস্থানে রয়েছে সে অবস্থান ধরে রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে উদ্যোগী হলে সে উদ্যোগ প্রবল রাজনৈতিক বিরোধিতার সম্মুখীন হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে বলছেন এবং তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ ২৩ মার্চ পতাকা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সভায় বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যান্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেভাবে নির্বাচন হবে। এর বাইরে কেউ যদি কোন ধরনের চিন্তা করেন, তাহলে লাভ হবে না।’ প্রধানমন্ত্রী ২৯ মার্চ, সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল প্রসঙ্গে পুনরায় বলেন, ‘আদালতের রায় আমরা সংসদে কার্যকর করেছি। তারা আদালতের রায় না মানলে আমাদের করার কিছু নেই।’ তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারদলীয় অন্যান্য নেতা-মন্ত্রীদের উপরি উক্ত বক্তব্য মেনে নিয়ে বিরোধী দল যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ, তারা বিশ্বাস করে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সে নির্বাচন অবাধ ও দুর্নীতিমুক্ত হবে না। সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করার সময় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার লক্ষ্যে নতুন সংবিধানে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা রাখেনি। এ লক্ষ্যে ৩ সদস্যের নির্বাচন কমিশনকে ৫ সদস্যের করা ছাড়া কমিশনকেও কোন বাড়তি সুবিধা, শক্তি বা স্বাধীনতা প্রদানের কথা বলা হয়নি। কাজেই এ রকম অবস্থায় মাননীয় মন্ত্রী-এমপিগণ নিজ নিজ পদে থেকে নির্বাচন করলে এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সে নির্বাচন যে নিরপেক্ষ হবে না সে বিষয়টি অনুধাবন করতে গবেষক হওয়া লাগে না।
এ প্রসঙ্গে বিরোধী দলীয় মনোভাব এবং দলগুলোর দাবি মানার জন্য প্রদত্ত ১০ জুনের আলটিমেটাম জেনেও এবং আন্দোলন বেগবান করতে চারদলীয় জোট ১৮-দলীয় জোটে সমপ্রসারিত করার মধ্যদিয়ে শক্তিবৃদ্ধি ঘটালেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ সব উপেক্ষা করে পূর্বের সুরেই কথা বলছেন। শেখ হাসিনার ৩১তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ও সমুদ্র বিজয় উপলক্ষে ১৭ মে ছাত্রলীগ প্রদত্ত সম্বর্ধনা সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পৃথিবীর আর দশটা গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেভাবে নির্বাচন হবে।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিরোধীদলীয় দাবি নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিছুই দিতে পারেনি, দিয়েছে অপশাসন। বাংলাদেশের মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপে আর দানব দেখতে চায় না।’ এ সঙ্গে তিনি বিরোধীদলীয় আন্দোলনের প্রতি কটাক্ষ করে বলেন, ‘আপনারা গাড়ি পোড়াবেন, মানুষ মারবেন—এসব ধ্বংসাত্মক কাজ পরিহার করুন। আমরা সহ্য করছি বলে মনে করবেন না এটা আমাদের দুর্বলতা। এটা আমাদের দুর্বলতা নয়। আমরা জানি কারা বাসে আগুন দিচ্ছে, দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর তাদের কীভাবে সঠিক পথে আনা যায়, সেটা আমাদের জানা আছে। কিন্তু আমরা তা করতে চাই না।’ তিনি নির্বাচনের সময়কাল সম্পর্কে জাতিকে ধারণা দিয়ে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দিতে হবে এবং ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে হতাশ হতে হয়। কারণ, নাগরিক সমাজ যখন কেমন সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হবে এটা জানতে ব্যাকুল তখন প্রধানমন্ত্রী কোন সময় নির্বাচন হবে সে বিষয়ে তাদেরকে জানাতে ব্যস্ত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে সমালোচনা তিনি করেন তাও যুক্তির ধোপে টেকে না। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দানবের সঙ্গে তুলনা করলেও দেশবাসী জানেন, বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহাম্মেদ, বিচারপতি হাবিবুর রহমান বা বিচারপতি লতিফুর রহমান ‘দানব’ ছিলেন না। তাঁদের সংক্ষিপ্ত শাসনকালকে ‘অপশাসন’ বলাও যৌক্তিক নয়। দেশবাসীকে বোকা মনে করে প্রধানমন্ত্রী অবৈধ, অসাংবিধানিক, অ-তত্ত্বাবধায়ক ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীন সরকারের অন্যায় কর্মকাণ্ডের দায় সুকৌশলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর চাপাবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। এ সব না করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ত্রুটিগুলো সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রী যদি উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে বিচারপতিদেরকে অন্তর্ভুক্ত না করে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার একটি নতুন রূপরেখার কথা শোনাতেন তাহলে রাজনৈতিক উত্তাপ হ্রাসের মধ্যদিয়ে জাতি দিক-নির্দেশনা পেতো। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী যদি বিশ্বাস করেন, দেশের অধিকাংশ নাগরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় না, তাহলে তিনি এ বিষয়ে একটি গণভোটের আয়োজন করে দেখতে পারেন। সাধারণ বিবেচনায় মনে হয়, এ প্রসঙ্গে মতামত গৃহীত হলে অধিকাংশ নাগরিক নির্দলীয় সরকারাধীনে সংসদ নির্বাচনের পক্ষে রায় দেবেন। আর বিরোধী দলের দাবি যদি যৌক্তিক হয় তাহলে যে সে দাবি এক সময় না মেনে পারা যাবে না, সে বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারছেন না।
মহাজোট সরকারের প্রথম সোয়া তিন বছরে সরকারি দল বিরোধী দলের প্রতি যে আচরণ করে তাতে মনে হয় না যে দলীয় সরকারাধীনে সংসদ নির্বাচন হলে সে নির্বাচন মুক্ত ও অবাধ হবে। নাগরিক সমাজও মনে করেন, দেশের রাজনীতি এবং নির্বাচনী সংস্কৃতিতে এখনও এমন ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি যা দেখে আশা করা যায়, এখনই দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন করার মত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। নাগরিক সমাজের মধ্যে ১২ মার্চে বিরোধী দলের প্রতি সরকারি দলের অমানবিক আচরণ লক্ষ্য করে এ বিশ্বাস আরও পোক্ত হয়েছে। কারণ, ওইদিন বিরোধী দল আহূত একটি নিয়মতান্ত্রিক ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসাবে রাজধানীতে আহূত মহাসমাবেশের প্রতি সরকার যেভাবে অঘোষিত ৭২ ঘণ্টার হরতাল ঘোষণা করে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ওই মহাসমাবেশে যোগদানে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদেরকে বাধা দেয় তাতে এই সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সে নির্বাচন যে কতটা মুক্ত ও অবাধ হবে তা তারা ভালভাবেই বুঝতে পারেন।
বিরোধী দলের পক্ষ থেকে তাদের নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি সরকারের না মানার কারণ হিসাবে যে ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে তা হলো, সরকারি দল দেশ পরিচালনায় প্রতি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ায় এ সরকারের জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে যা এ সরকারের সময় অনুষ্ঠিত উপনির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও ইউপি নির্বাচনের ফলাফল এবং কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের সামপ্রতিক জরিপে প্রমাণিত হয়েছে। এমতাবস্থায় সরকার বুঝতে পেরেছে, মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন হলে সরকারের পক্ষে নির্বাচনে জয়ী হওয়া সম্ভব হবে না। এ কারণে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে সুপরিকল্পিত উপায়ে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে সরকার আবারও ক্ষমতায় আসতে চাইছে। সে কারণে বিরোধী দল দলীয় সরকারের অধীনে কিছুতেই নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি হতে চাইছে না। আর প্রধান বিরোধী দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তা হলে জেনারেল এরশাদকে বিরোধী দল সাজিয়ে, বা অন্য কোন উপায় অবলম্বন করেও ওই নির্বাচনকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব হবে না। প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বোকামি করলে তা হবে রাজনৈতিক সহিংসতাকে ডেকে আনা। এমন নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলেও সে সরকার যুগপত্ দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না এবং প্রথমদিন থেকে ওই সরকারকে তীব্র আন্দোলন মোকাবেলা করতে হবে।
বিরোধী দলও সরকারি দলের পরিকল্পনা যে বুঝতে পারছে না তা নয়। সে জন্য তারাও সুপরিকল্পিতভাবে তাদের নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির পক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করছে। এ পরিকল্পনায় জনসমর্থন পাওয়ার জন্য বিএনপি সনাতনী হরতাল থেকে সরে এসে অহিংস রোডমার্চের মধ্যদিয়ে তাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার যে চেষ্টা করে তা সাধারণ মানুষের সমর্থন পায়। এ প্রক্রিয়ায় অঞ্চল ভিত্তিক রোডমার্চ করে দলটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠনের দাবিকেই কেবল জনপ্রিয় করেনি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দলীয় কোন্দল নিরসনের মধ্যদিয়ে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করে। সে কারণে ১২ মার্চ দলটি এর ঐক্যবদ্ধ শক্তি নিয়ে রাজধানীতে মহাসমাবেশ ডাকলে সরকার অকারণে ভীত হয়ে পড়ে। ওই মহাসমাবেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের যোগদানে বাধা দেয়ার জন্য সরকারের প্রায় যুদ্ধ ঘোষণার মধ্যে এ ভীতি সৃষ্ট হয়। বিএনপির এসব আন্দোলন কর্মসূচির অন্যতম মূল দাবি হলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান। দলটি রাজপথে এ দাবির পক্ষে দেশব্যাপী আন্দোলন করে রাজধানী ঢাকায় মহাসমাবেশের মাধ্যমে সরকারকে তিন মাসের সময় বেঁধে দেয় এবং এ সময়ের মধ্যে এ দাবি না মানলে কঠোর আন্দোলনের হুমকি প্রদান করে।
অন্যদিকে সরকারি দলও জোটগতভাবে বিরোধী দলগুলোর নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবির জন্য সূচিত আন্দোলন মোকাবিলার জন্য পাল্টাপাল্টি সমাবেশ মহাসমাবেশ করে। এহেন সরকারি কর্মসূচি গৃহীত হওয়ায় সরকারি দলের নেতা-কর্মীরাও চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। এসব সমাবেশে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের বক্তব্যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে যতটা যুক্তি দেয়া হয় তার চেয়ে বেশি বক্তব্য দেয়া হয় বিরোধী দলের বিরুদ্ধে। সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা দাবি করেন, বিরোধী দল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য তাদের আন্দোলন পরিচালনা করছেন। সরকারি দল যেহেতু দাবি উত্থাপন করতে পারে না, সে কারণে এর নেতা-কর্মীদের বক্তব্যে বিরোধী দলের সমালোচনা থাকে বেশি। এসব সমাবেশে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পথ নক্শার ওপর কদাচিত্ আলোকপাত করা হয়। যেহেতু দেশের সাধারণ মানুষ মনে করেন, রুগ্ন রাজনীতিতে ‘দিন বদল’ না ঘটায় এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সমঝোতা ও সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরিবর্তে অবিশ্বাস ও প্রতিহিংসা আরও প্রবল হওয়ায় এ দেশে এখনও দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন করার মত সময় আসেনি, সে কারণে বিরোধী দলগুলোর নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি নাগরিক সমাজের সমর্থন পাবে। এভাবে নাগরিক সমাজ যদি বিরোধী দলীয় দাবিকে ব্যাপকভাবে সমর্থন দেয় তাহলে সরকারের পক্ষে দমন-পীড়ন আর গণগ্রেফতার করে এ দাবিকে বাধাগ্রস্ত করা সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেহেতু বাতিল করা হয়েছে এবং সরকারের পক্ষ থেকেও যেহেতু বার বার বলা হচ্ছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না, সে কারণে অন্য কোন নাম দিয়ে নির্বাচিত, অনির্বাচিত বা নির্বাচিত ও অনির্বাচিত ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকেই একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেখার বিষয়, বিরোধী দলগুলো কঠিন আন্দোলনে যাওয়ার আগে সরকার সহিংসতা ও রক্তক্ষয় এড়িয়ে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমত তৈরি করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ নির্মাণের কৃতিত্ব অর্জন করতে পারে কিনা।
লেখক: অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
akhtermy@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন