শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১২

তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতির বাস্তবতা


॥ প্রফেসর আ ন ম মুনির আহমদ চৌধুরী ॥


সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বহুল আলোচিত এবং ব্যাপক জননন্দিত জ্বলন্ত প্রবাহ হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিস্থাপন প্রসঙ্গ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে প্রতিস্থাপনের দাবি নিয়ে ৩০ জুন ২০১১ থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ও সমমনা দলগুলোর সমন্বয়ে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। আন্দোলনে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৭ অক্টোবর ২০১১ থেকে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে হাজার হাজার গাড়িবহরে সহস্র নেতাকর্মী নিয়ে চারদলীয় জোট এবং সমমনা দলগুলো সিলেট বিভাগ অভিমুখে রোডমার্চ শুরু করে। রোডমার্চের প্রথম দিনেই তৃণমূলপর্যায়ে ব্যাপক জনসম্পৃক্ততার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিস্থাপনে গণদাবির যৌক্তিকতা দেশে-বিদেশে আগ্রহী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। এরপর রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের রোডমার্চেও গণজোয়ার তীব্রতর হয়ে ওঠে। সর্বশেষ চট্টগ্রামের রোডমার্চ সৃষ্টি করে জনতার মহাসমুদ্রের নতুন ইতিহাস। এত বিশাল জনসমাবেশ বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয়টির নজির নেই। মহানগর থেকে জেলা শহর, উপজেলা শহর, হাটবাজার, গ্রামীণ জনপথ, লোকালয় বেয়ে বেয়ে যে মহাসড়কগুলো বাংলাদেশকে রাজধানী ঢাকার সাথে সংযুক্ত করেছে এ ধরনের দীর্ঘ পথে সুদীর্ঘ লাইনে জড়ো হয়ে থাকা জনতার অভিনন্দনের সারি অতিক্রম করে পথসভা-জনসভার মাধ্যমে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সৃষ্টি করেছেন ব্যাপক গণজাগরণ। কোটি কোটি জনতা নবোদ্দীপনায় অভিনন্দিত করেছেন মহামিছিলের মহান নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে এবং তার উপস্থাপিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিস্থাপনের দাবিকে। দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক স্থবিরতা কাটিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন বাংলাদেশে প্রচণ্ড রাজনৈতিক গতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। এক বিশাল মেজাজের বিবর্তন ধারার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, জোট এবং শক্তিগুলোর নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ সম্পন্ন হয়েছে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনুষ্ঠিত দেশব্যাপী গণমিছিলের আকার ও প্রকৃতি পূর্বাভাস দিচ্ছে বাংলা ভূখণ্ডে ঘটে যাওয়া দুনিয়া কাঁপানো ১৯৬৯ ও ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের ঠিকানা খোঁজার।

তিন জোটের রূপরেখা এবং নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান
বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে স্বৈরশাসক এরশাদ দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করে দেন। এতে নির্বাচনে ভোটদানের প্রতি জনগণের ব্যাপক অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়। নির্বাচনকার্যক্রম ও ভোটিংব্যবস্থা একশ্রেণীর অবৈধ অস্ত্রবাজ, সন্ত্রাসী, কালো টাকার মালিকের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ভোটকেন্দ্র দখলের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকায় এরশাদ আমলের প্রায় প্রতিটি নির্বাচন ভোটারবিহীনভাবে সম্পন্ন হয়। রাষ্ট্রকে সুব্যবস্থিত করার জন্য এরশাদের ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রবল জনমতের সমর্থনে ১৯৯০ সালে তিন জোটের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়। এ রূপরেখায় সংবিধানের কোনো পরিবর্তন ব্যতিরেকে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্নের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আবশ্যকতা ঘোষণা দেয়া হয়। এ ভিত্তিতে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। এ সরকার ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে নির্দলীয় নিরপেক্ষ প্রশাসনিক ধারায় সর্বপ্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে।
পঞ্চদশ সংশোধনী গণরায়ের মাধ্যমে বিধিবদ্ধতা অর্জন করেনি। সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অজুহাতের সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে গণরায় গ্রহণ থেকে বিরত থাকার সুযোগ পায়। গণভোট পৃথিবীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর বিশেষ প্রয়োজনে জনমত যাচাইয়ের স্বীকৃত সাংবিধানিক পন্থা। এ পন্থা সুপ্রিম কোর্ট কেন বাতিল করেছেন তার উত্তর সম্ভবত রায়ের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের মধ্যেই নিহিত আছে। শেখ হাসিনার ইচ্ছা এবং প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের বিষয়ে যে একটা সুস্পষ্ট যোগাযোগ ছিল, তাতে সন্দেহ করার কিছু নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল প্রসঙ্গে ড. আকবর আলি খান বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কোনো আইনি বিষয় নয়, এটি একটি সামাজিক চুক্তি। আইন দিয়ে এটি ভাঙা বা পরিবর্তন করা যাবে না। বাংলাদেশে এখন যে ধরনের নির্বাচন দরকার তা শুধু নির্বাচন কমিশন দিয়ে সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন দিয়ে হয়তো সূক্ষ্ম কারচুপির নির্বাচন ঠেকানো যেতে পারে, তবে স্থূল কারচুপি রোধ করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখতে হবে।’

পঞ্চদশ সংশোধনী পাস এবং বিধিবদ্ধতার প্রশ্ন
১১ মে ২০১১ তারিখে সুপ্রিম কোর্টের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত না হলেও যে মূল কারণ বাতিলের পক্ষে নির্দেশনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছেÑ ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হওয়ায় তা সংবিধানের মৌলিক চেতনা গণতান্ত্রিক কাঠামো বিরোধী’। আবার এই রায়ে আগামী দু’টি নির্বাচন জাতীয় প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে রায়ে দ্বৈত নীতির প্রতিফলন ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন উত্থাপন করা বাঞ্ছিত যে, ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী গঠিত বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সরকারের মূল্যায়ন কিভাবে হবে তা আদালত স্পষ্ট করেননি। ১৯৯৫-৯৬ সালে সহিংস কর্মসূচির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যারা আন্দোলন করেছিলেন, তাদের বহুল কথিত উক্তি, ‘সংবিধান জনগণের জন্য, জনগণের প্রয়োজনে সংবিধান, সংবিধানের জন্য জনগণ নয়’Ñ এ ধরনের পপুলিস্ট রাজনৈতিক আন্দোলনের বৈধতা অবশিষ্ট থাকবে কি না। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ না পাওয়ায় ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো সম্পর্কে আদালতের পর্যবেক্ষণ অজানা থাকছে। ২০০৬ ও ২০০৭ সালে চরম সহিংসতা ও লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যার পর মৃত ব্যক্তির বুকের ওপর দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসীদের হিংস্র উল্লাস ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্দলীয় নিরপেক্ষ চরিত্র অটুট রাখার লক্ষ্যে সংঘটিত হয়েছিল বলে মহাজোট নেতারা দাবি করে থাকেন। ‘অনির্বাচিত’ এ অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অবৈধ ঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের পর যখন রাজধানী ঢাকাকে বিভক্ত করে দু’জন অনির্বাচিত শাসক এবং ৬৩ জেলায় জেলাপরিষদ প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়, তখন সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মৌলিক চেতনা সংরক্ষণ হলো কি না এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া স্বাভাবিক। সরকারের এ ধরনের কার্যকলাপের বিচারের ভার সুধী, সুজন এবং সামগ্রিকভাবে জনগণের ওপর বর্তেছে।

পঞ্চদশ সংশোধনী এবং কাকতালীয় বিষয়
অক্টোবর ২০১১ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্রে অত দ্রুত পরিবর্তনের মূল কারণ ৩০ জুন ২০১১ তারিখে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী। জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের তিন-চতুর্থাংশের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল সংবলিত পঞ্চদশ সংশোধনীর অনুকূলে ভোট গ্রহণের ব্যাপারে কোনো অসুবিধা হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সপক্ষে ভোট পড়েছে ২৯২টি। বিপক্ষে মাত্র ১ ভোট। বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত থাকেনি। এ ধরনের ভোট পর্বে বিএনপির উপস্থিত থাকার অর্থ দাঁড়াত গণতন্ত্রের বিধিবদ্ধ পন্থায় ‘ ‘Agree to differ’ করা। অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনী গ্রহণে উপস্থিত থেকে ভিন্ন মত ব্যক্ত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিলকে উপস্থিতি জাতীয় বৈধতাও দেয়নি বিরোধী দল। মোট কথা, বিএনপি প্রাথমিকভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসহ পঞ্চম সংশোধনীর সব বিধানকেই আইনগত প্রক্রিয়া এবং রাজনৈতিক ধারায় বর্জন করেছে। কাকতালীয়ভাবে পঞ্চদশ সংশোধনীর পক্ষে ভোটের সংখ্যার সাথে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি গৃহীত গণতন্ত্র হত্যার জন্য প্রণীত কুখ্যাত চতুর্থ সংশোধনীর ভোটের সংখ্যা ২৯২-এর অপরূপ মিল ঘটেছে। চতুর্থ সংশোধনী গ্রহণের সময় যেমন সব কিছু মাত্র ১৩ মিনিটে সম্পন্ন করা হয়েছে, তেমনি কোনো প্রকার আলোচনা এবং বিতর্ক ব্যতিরেকে দ্রুততায় সম্পন্ন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল সম্পর্কিত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ২৫ জানুয়ারি ২০০৯ তারিখে। তারিখটি একদলীয় মহাপরাক্রমশালী নৃপতি শাসিত বাকশাল পদ্ধতি প্রচলনের কারণে আমাদের রাষ্ট্রীয় দিনপঞ্জিতে এমনিতেই বিতর্কিত হয়ে আছ। অবশ্য পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী ৭(ক) এবং ৭(খ) ধারায় রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভিন্ন মত প্রকাশ, জাতীয় প্রয়োজনে গণইচ্ছা অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তনকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে পরিগণিত করার বিধান করা হয়েছে, যা প্রকারান্তরে কুখ্যাত বাকশালতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ও সাংবিধানিক উদ্যোগ হিসেবে অভিহিত করা যায়। বাংলাদেশ সংবিধান সংশোধন করে ২০১০ সালে দিল্লিতে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো ভবিষ্যতে যেন সংসদ সদস্য দ্বারা বা অন্য কোনোভাবে প্রকাশ না পায় তার বিধান করা হয়েছে। এ সংশোধনী স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণসার্বভৌম চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে রজানৈতিক বক্তব্য
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সপক্ষে প্রধানমন্ত্রী ২০০৭-২০০৮ সময়ের সামরিক বাহিনী সমর্থিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রমের বিষয় উল্লেখ করে থাকেন। এ সময়ের ঘটনাবলি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতার প্রতি বিদ্রƒপ এবং শ্লেষাত্মক মন্তব্য প্রায়ই করে থাকেন। অথচ ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথমত সংবিধানসম্মত ছিল না, দ্বিতীয়ত এ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে মহাজোটের বিশাল নেতৃবহর নিয়ে উপস্থিত ছিলেন শেখ হাসিনা, তৃতীয়ত মঈন-ফখরুদ্দীনের অসাংবিধানিক অবৈধ সরকারের সব অপকর্মের বৈধতা প্রদানের প্রকাশ্য প্রতিশ্রুতি প্রদান করে ছিলেন শেখ হাসিনা, চতুর্থত মঈন-ফখরুদ্দীন সরকারকে বিচারের কাঠগড়ায় আনয়নের সব ধরনের প্রশাসনিক ও আইনগত ক্ষমতা প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও যখন তাদের বিচারের আওতায় আনায়ন করা হচ্ছে না, তখন এ ধরনের পরিবেশে বিগত সমরজান্তা সমর্থিত অবৈধ সরকারের প্রসঙ্গ উপস্থাপন বর্তমান সরকারের জন্য শোভনীয় হচ্ছে না। কোনো নিষ্ঠুর সমালোচক যদি মনে করেন অবিশ্বাসের কল্পনায় ২০০৬ সালে বিচারপতি কে এম হাসানের প্রতি আওয়ামী জোটের অনাস্থা প্রকাশ করার প্রধান কারণ অবৈধ, অসাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র রচনাÑ এখন কি তা অমূলক বলা যাবে? বাংলাদেশের যেকোনো সাধারণ নাগরিকের মনে এ প্রশ্ন যদি জাগ্রত হয় : (ক) ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার ইচ্ছা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার, তাই তা প্রতিষ্ঠা করা হলো, (খ) ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে আপত্তি উপস্থাপন করে বিতর্ক সৃষ্টির ইচ্ছা হয়েছে সুতরাং বিতর্ককে লগি-বৈঠার সংঘর্ষে রূপ দেয়া হলো, (গ) আবার ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের অপ্রকাশিত রায়ের অবৈধ ঘোষিত আদেশের অর্ধাংশ বাস্তবায়ন দলীয় স্বার্থে অগ্রগণ্য বিবেচিত হলো, তাই আদালতের অজুহাত দেখিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হলো এ যেন একজন নেতার ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও অভিপ্রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রÑ বাংলাদেশ। এ ধরনের অদায়িত্ব ম্পন্ন ব্যক্তিগত ইচ্ছার যথার্থ জবাব দেয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিস্থাপন আন্দোলন
(ক) প্রথম পর্যায়ে পাঁচজন প্রাণ হারালেন : ইতোমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত গণমিছিলে একশ্রেণীর হাঙ্গামাপ্রিয় দাঙ্গাবাজ সশস্ত্র পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন তৃণমূলপর্যায়ের পাঁচজন নিরস্ত্র বিক্ষোভকারী। পুলিশ এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের সশস্ত্র কর্মীদের আক্রমণে দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন স্থানে গণমিছিলে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। সব ধরনের হার্মাদি বর্বরতাকে হার মানিয়ে বাংলাদেশের একশ্রেণীর পুলিশ চাঁদপুরে গুলিতে নিহত যুবক লিমন ছৈয়ালের লাশকে বিবস্ত্র করে বনমানুষের আদিমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে জাতির কপালে কলঙ্ক লেপন করেছে। পৃথিবীবাসীর কাছে জাতি পরিচিতি পেয়েছে হীন ও কদর্য স্বভাবপ্রিয় জনগোষ্ঠী হিসেবে। গুলি মেরে হত্যার পর আছার মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করাÑ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যের এটা কোন ধরনের উল্লাস তা সভ্য মানুষের বোধের বাইরে। মৃতদেহ অসাড় হয়ে আছে, পরিধেয় কাপড় টেনে রাখার কোনো শক্তি যার হাতেপায়ে নেই, তার অন্তর্বাসসহ প্যান্ট খুলে নেয়া এ কোন নগ্ন দৃশ্য একশ্রেণীর পুলিশ দেশবাসীকে প্রদর্শন করল তা বোঝা দায়। লিমন ছৈয়াল বয়সে যুবক। তাই মৃত লিমনকে বিবস্ত্র করে জনাকয়েক পুলিশ বুঝাতে চেয়েছে প্রতিবাদকারী যুব শক্তিকে এভাবেই শাস্তি দেয়া হবে। লিমনকে প্রতীক হিসেবে ধরলে বলা যায়, পুলিশ যেন সব যুবসমাজকেই বিবস্ত্র করল। একশ্রেণীর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ ধরনের অসভ্য আচরণের প্রতিবাদ মৃত লিমন করতে পারবেন না এটা ঠিকÑ কিন্তু এ দৃশ্যপটে নিঃসন্দেহে গড়ে ওঠবে শতকোটি প্রতিবাদ। প্রতিবাদের শক্তিই গড়ে তুলবে নিরস্ত্র জনতার বাঁধভাঙা প্রতিরোধ। 
(খ) ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম ঘোষণ এবং প্রতিক্রিয়া 
গত ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহাসমাবেশ থেকে বেগম খালেদা জিয়া ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের সব বিভাগীয় ও জেলা সদরে গণমিছিল এবং ১২ মার্চ ‘চলো চলোÑ ঢাকা চলো’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। গণমিছিলের মাত্র তিন দিন আগে হঠাৎ করে একই দিন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঢাকায় সমাবেশের ডাক দেয়া হয়। দু’টি বড় দলের পরস্পরবিরোধী কর্মসূচির অজুহাতে ডিএমপির পক্ষ থেকে সব ধরনের সমাবেশ ও মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এ সময় গণমিছিল বন্ধ করার নিমিত্তে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। যেসব জেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারি হয়নি সেসব শহরে গণমিছিল শুরু হলে পুলিশ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা মিছিলের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ ও হাঙ্গামার সৃষ্টি করে। এতে ২৯ জানুয়ারি নিহত হন চারজন, আর আহত হয়েছেন কয়েক শতাধিক প্রতিবাদী মানুষ। সরকারি নিষেধাজ্ঞা আমলে রেখে বিএনপি ২৯ তারিখের কর্মসূচি ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। অন্য দিকে আওয়ামী লীগ আবার একই সময়ে সমাবেশের ঘোষণা দেয়। ২৯ তারিখ রাতে সরকারি সিদ্ধান্ত ও আওয়ামী লীগের কর্মসূচির বিষয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় জনগণের নানা স্তর থেকে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রতিবাদ আসে। বিভিন্ন পেশার মানুষের তীব্র সমালোচনার মুখে সরকারের অন্যান্য বলদর্পী আচরণ কিছুটা সংযত হয়। ফলে ৩০ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকাসহ দেশবাসী লাখ লাখ প্রতিবাদী জনতার গণমিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সব মিছিলের প্রধান ও একমাত্র দাবি হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রতিস্থাপনের বিষয়টি প্রতিধ্বনিত হয়।

(গ) ১২ মার্চ মহাসমাবেশকে ঘিরে ফ্যাসিবাদী তৎপরতা 
১২ মার্চ ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ও সমমনা দলগুলোর ঢাকা চলো মহাসমাবেশ। এ সমাবেশ ঘিরে দেশজুড়ে যখন জনজোয়ার সৃষ্টি হয়, তখনি সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও জোট মার্চ মাসজুড়ে নানা কিসিমের কর্মসূচি ঘোষণা করে। প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ১৪ দলের নামে মহাসমাবেশ আহ্বান করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের সমালোচনা ও ক্ষোভের মুখে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও আওয়ামী লীগ ওই দিবসের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়। অন্য দিকে আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর হাইব্রিড নেতা ৭ মার্চ গণমিছিল, ১১ মার্চ মানববন্ধন ও ১৪ মার্চ ঢাকায় মহাসমাবেশের আয়োজন করে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সার্বিক সহযোগিতায় একশ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর উপস্থিতিসহ উপর্যুক্ত কর্মসূচিসহ নির্বিঘেœ পালিত হয়। পক্ষান্তরে ১২ মার্চের মহাসমাবেশ বানচাল ও জনসমাবেশ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসন, পুলিশ, র‌্যাব এবং বিজিবি দিয়ে রাজধানী ঢাকার প্রতিটি প্রবেশ মুখে চেকপোস্ট বসিয়ে পুরো দেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। রাজনীতিক বিশ্লেষক ও সাধারণ মানুষের মতে, ১০, ১১ ও ১২ মার্চ সরকার বাস, ট্রেন, লঞ্চ, স্টিমার, নৌকা, ট্রাক, লরি, ট্যাক্সিক্যাব, মাইক্রো, হাইস প্রভৃতি যানবাহন বন্ধ করে দিয়ে সরকারের তরফ থেকেই তিন দিন হরতাল পালন করা হয়। ঢাকা মহানগরীতে আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, কমিউনিটি সেন্টার বন্ধ করে দিয়ে সব ধরনের ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক লেনদেনের ওপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ১২ মার্চ মহাসমাবেশে যোগদানের সব রুটে পুলিশ, র‌্যাব এবং বিজিবির সাথে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সশস্ত্র ক্যাডার বসিয়ে দেহ তল্লাশি, পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল এবং টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে আইডি কার্ড চেয়ে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি কদর্য বাহিনীর মতো সাধারণ মানুষের সাথে বীভৎস আচরণ করা হয়। এতে রামদা, ছুরি, কাঁচি, লাঠি, হকিস্টিক প্রভৃতি নিয়ে পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নামধারী একশ্রেণীর দুর্বৃত্তের বেপরোয়া গুণ্ডামি চলেছে। সাভার থেকে ঢাকা আসার পথে মহাসড়কজুড়ে টুল টেবিল নিয়ে আওয়ামী লীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা অবস্থান গ্রহণ করে মূলত সড়ক অবরোধ পালন করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অর্থাৎ পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি প্রভৃতির মুখ্য কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী বৈধ ব্যক্তি ছাড়া অন্য সবার কাছে সংরক্ষিত সব ধরনের অস্ত্র বেআইনি ঘোষিত থাকায় তা জব্ধ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ করে গ্রেফতার করা। অথচ বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ মিডিয়ার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করল ভিন্ন নারকীয় দৃশ্যÑ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের সহাবস্থান। এলিট ফোর্স নামে এক সময়ে প্রশংসিত র‌্যাবের সম্মুখে এ ধরনের আলামত এত বেশি বেমানান যে নাগরিকরা স্বাভাবিক কারণেই জনজীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে আছে। ১২ মার্চ মহাসমাবেশ সম্প্রচারে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সরকারি নিষেধাজ্ঞা জনগণের মৌলিক অধিকারের মর্মমূলে পদাঘাত করেছে মহাজোট সরকার। 
সরকার যে ধারার পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করেছে তাতে বাংলাদেশকে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র না বলে সামন্ত রাজা বাদশাহর সাম্রাজ্য হিসেবে অভিহিত করা যায়। এ ধরনের সামন্ত মানসিকতাসম্পন্ন পশ্চাৎপদ সরকার ও রাজনৈতিকব্যবস্থা, পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা দাসানুদাসের ভূমিকা পালন করে আধুনিক রাষ্ট্র ও নাগরিকতার সংজ্ঞা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে ধূলিসাৎ করে চলেছেন তাদের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় অর্থবহ, গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে যেন সোনার পাথর বাটি। মহাজোট সরকারের সামগ্রিক কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি প্রতিস্থাপনের দাবি এখন বাংলাদেশের জনগণের মুখ্য দাবিতে পরিণত হয়েছে। অথচ মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রতিস্থাপনের আন্দোলনের যৌক্তিক মীমাংসার পথ পরিহার করে সম্ভবত দ্রুত সাংঘর্ষিক ও নৈরাজ্যিক পথেই জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ধাবমান করছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্বৈর স্বভাবনির্ভর সরকারের মহাপতন ঘটার সম্ভাবনা থাকে।

১০. জাতি সঙ্কটে নিপতিত হতে চায় না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে খালেদা জিয়া কালো আইন করেছেন।’ স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো ছিল সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট।’ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের কথামালার যেন শেষ নেই। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতাদের ১৯৯৫-৯৬, ২০০৬-০৭ সময়ে প্রদত্ত বক্তৃতা বিবৃতি এবং কথামালার সাথে বর্তমানে বক্তৃতা বিবৃতির তুলনামূলক বিশ্লেষণের অনুরোধ জানানো যায়। বিরোধীদলের নেতার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিদ্রƒপ, শ্লেষাত্মক ও অরাজনৈতিক বক্তব্য শ্রেয় বোধের পরিচয় বহন করে না। আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধাজনক অবস্থান হচ্ছে জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের অধিক আসনে দলটির একক প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। শরিক দলগুলোসহ প্রতিনিধিত্বের সংখ্যা তিন-চতুর্থাংশের বেশি। নির্বাচনী অঙ্গীকার না থাকা সত্ত্বেও দলটি আদালতের কথিত রায়ের অপব্যাখ্যা করে একমাত্র জাতীয় সংসদে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে। এ ধরনের বাতিল গণইচ্ছার সম্পূর্ণ পরিপন্থী বিধায় সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এককভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করতে পারে। এতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সৃষ্ট সঙ্কট সমাধান সহজ হবে। ১৯৯৫ সালে জাতীয় সংসদে বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ছিল না। তা ছাড়া ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পাটি, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ সব বিরোধীদলীয় সদস্য পদত্যাগ করায় বিএনপি একার পক্ষে সংবিধানে সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থাকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না। ফলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি নির্বাচন গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ও গণ আকাক্সার প্রতিফলনের জন্য অপরিহার্য ছিল। বর্তমানে জাতি কোনো অবস্থায় ১৯৯৬ অথবা ২০০৭ সালের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি চায় না। কারণ এ ধরনের পরিস্থিতির পরিণাম হতে পারে এবার আরো ভয়ানক, বীভৎস এবং বেদনাদায়ক যা জাতি কখনো কামনা করে না।
শেষ কথা : বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার সব প্রতিষ্ঠান চরম দলমন্যতা ও একশ্রেণীর ঊর্ধ্বতন আমলা, কর্মকর্তা, বিচারক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের কারণে নিরপেক্ষতা এবং নৈর্ব্যক্তিকতা হারিয়ে আইনের বস্তু ও ব্যক্তিনিরপেক্ষ প্রয়োগে অক্ষম হয়ে গেছে। যে রাষ্ট্রে পুলিশ বাহিনীর একশ্রেণীর কর্মকর্তা, সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের জন্য গঠিত র‌্যাব, জনপ্রশাসনে নিয়োজিত একশ্রেণীর আমলা, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশনসহ সব সংস্থাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বাস্তবায়নে নির্বাহী বিভাগের রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণে কাজ করেÑ এ ধরনের ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিনায়কত্বে বলবৎ রেখে নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং জনগণের নিরুপদ্রব ভোটাধিকার সংরক্ষণ কোনো অবস্থায় সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন কূটকৌশল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনীকেও বিতর্কিত করার অপপ্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে। এ ধরনের অশুভ পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়ে পূর্ণ কর্তৃত্বসম্পন্ন দেশপ্রেমিক নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, সৎ, সতর্ক, সাহসী, কর্মঠ, সাবধান এবং যতœসহকারে অর্পিত দায়িত্ব পালনে একাগ্র ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে অস্থায়ী সরকার গঠনের বিকল্প নেই। অস্থায়ী সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে নামেই বলা হোক না কেন এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কোনো সংজ্ঞা নেই। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি উন্নত দেশে চলমান সরকার নির্বাচনকালে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালন করে থাকে। এ সময়ে রুটিন কর্মের বাইরে কোনো দায়িত্ব সরকার পালন করে না বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে সংবিধান ও আইনের পরিপূর্ণ নৈর্ব্যক্তিকতায় নির্বাচনসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাদি সম্পন্ন করে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে, সন্ত্রাসী, অস্ত্রবাজি ও দাপটের মুখে নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিরুপদ্রব করা দুষ্কর। তাই জনগণের চাহিদা অনুসারে বাংলাদেশ এ ধরনের রাজনৈতিক ঝগড়া ও বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানসম্মত এবং নিয়মতান্ত্রিকতা প্রদান করেছে। এ পদ্ধতি বাংলাদেশের নিজস্ব উদ্ভাবন। এ ধরনের সরকারের সাফল্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রচিন্তার একক কৃতিত্বও রয়েছে। যেকোনো স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন সময়টিকে ক্রান্তিকাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ সময়ে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকারের কার্যাবলির মূল্যায়ন করে। ক্ষমতাসীন সরকারের তত্ত্বাবধানে এ ধরনের মূল্যায়ন ধারার নির্বাচনে এশিয়া-আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অনাস্থার কারণে দাঙ্গা-হাঙ্গামা এমনকি গৃহযুদ্ধের সৃষ্টি করছে। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় নির্বাচনকালীন পরিস্থিতিকে পরিবর্তনকালীন সময় বলা যায়। এ সময়ে সংবিধান অনুযায়ী গঠিত এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারকে স্বাভাবিক নিয়মেই বৈধ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কারণ শাসনতন্ত্র প্রশ্নে জনগণের মতামতই চূড়ান্ত ও শেষ কথা। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অন্তর্বর্তী সরকার বলা যেতে পারে। আমাদের স্মরণ রাখা বাঞ্ছিত যে, ২০০৬ সালের মতো কূটনৈতিক দুষ্টচক্র আবারো সক্রিয় হতে চেষ্টা করছে। তাই জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে আমাদের নিজস্ব বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দিয়ে ভূমিকা রাখা এ মুর্হূতে অত্যন্ত জরুরি। রাষ্ট্রক্ষমতা বদলের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে নির্বাচনে জনগণের নির্ভয়ে অংশ নেয়া নিশ্চিত করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিস্থাপন আন্দোলন সফল করার দায়িত্ব প্রত্যেক নাগরিকের কাঁধে তুলে নিতে হবে। নতুবা গণতন্ত্র থাকবে না- দেশও বাঁচবে না। (শেষ) 
লেখক : সভাপতি, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ ,সাবেক সভাপতিÑ চ.বি. শিক্ষক সমিতি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন